চিরব্যস্ত শহুরে কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে যখন আপনার মন চায় একটুখানি প্রশান্তির খোঁজ, তখন ঢাকার অদূরেই অবস্থিত এই ১০টি গন্তব্য হতে পারে আপনার জন্য সেরা উপায়। ধূলিমলিন ধূসর শহরের জমজমাট জীবন থেকে দূরে এমন এক স্থান যেখানে প্রকৃতি তার মায়া ছড়িয়ে দিয়েছে আর ইতিহাস যেন তার নিজস্ব গল্প বলছে- পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে এমন একটা জায়গায় একটা দিন কাটালে মন্দ কি?
চলুন, ডে-ট্রিপের জন্য ঢাকার আশেপাশে ১০টি মনোমুগ্ধকর স্থান সম্পর্কে জানি, যা আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে করে তুলবে আরও রঙিন ও আর আপনার স্মৃতির আর্কাইভে যোগ করবে কিছু মহামূল্যবান স্মরণীয় মুহূর্ত।
ঢাকার আশেপাশে ১০টি মনোমুগ্ধকর স্থান-
১. মাওয়া: পদ্মার রূপকথা
মাওয়া, যেখানে পদ্মা নদীর তীরে সূর্যাস্তের রঙিন আলোকচ্ছটা আপনাকে মুগ্ধ করবে। গুলিস্তান থেকে মাত্র দুই ঘন্টায় এক্সপ্রেস হাইওয়েতে লং ড্রাইভ দিতে দিতে পৌঁছে যাবেন পদ্মাপাড়ে। পদ্মাসেতু উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে এখানে প্রচুর ভ্রমনপিপাসুরা আসেন।
তাদেরকে কেন্দ্র করেই পদ্মাপাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য খাবারের দোকান, এখানে পদ্মার তাজা ইলিশের স্বাদ না নিয়ে ফিরে যাওয়া মানেই আসল মজা মিস করে ফেলা! প্রথমে আপনার পছন্দের জায়গা থেকে ইলিশ মাছ কিনে নিতে পারেন। এরপর, একটি হোটেল বা রেস্টুরেন্ট বেছে নিন এবং সেখানে আপনার কেনা মাছটি রেস্টুরেন্টের কর্মীরা বেছে কেটে দেবে এবং রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় তেল কিনে দেবে বা আপনাকে কিনতে বলবে।মুখরোচক সর্ষে ইলিশ থেকে শুরু করে মাথা আর লেজের ভরতা, বেগুন ভাজা,খিছুড়ি- কি নেই এখানে! খাবার পরিবেশনের সময় তারা ভাত, পানি, ডাল, এবং কোমল পানীয়ও দেবে। বর্ণনা করতেই তো জিভে জল চলে আসে!
এদিকটায় আবার বেশ কিছু রিসোর্টও আছে, যেখানে স্বপরিবারে কাটানো যায় সারাদিন আর অনেক রকম ফান গেইমস ও অ্যাক্টিভিটিস উপভোগ করা যায়। তন্মদ্ধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল মাওয়া রিসোর্ট।
২. জিন্দা পার্ক: প্রকৃতির কোলের স্নিগ্ধতা
কুড়িল বিশ্বরোডের কাছেই নারায়ণগঞ্জ জেলায় ঢাকা থেকে ৩৭ কিমি দূরে পূর্বাচলের উত্তর-পূর্ব দিকে ইস্টার্ন বাইপাস রোড ঘেঁষে এই পার্কটি অবস্থিত। উত্তরে ও পূর্বদিকে একটি ছোট হ্রদ একে ঘিরে রেখেছে। এখানে আপনি প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
প্রায় ২৫০ প্রজাতির প্রায় ২৫ হাজার গাছ আর পাঁচটি লেইক এখানে রয়েছে, যা মোট জায়গার প্রায় ২৫ শতাংশ। এছাড়াও আছে ট্রি-হাউস,ছোট ছোট টিলা, ফুলের বাগান এবং লেইকগুলোর ওপর ব্রিজ। বিদ্যালয়, মসজিদ, পাঠাগার, কটেজ, অফিসসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনাও আছে।
চির কোলাহলপূর্ণ রাজধানীর কোনও এক সুউচ্চ দালানের একটা ঘরে বসে যখন হাঁপিয়ে উঠেন, তখন বন্ধু কিংবা পরিবারের সাথে একটা ডে ট্রিপ দিতে পারেন জিন্দা পার্কে, আশা করি মনোরম প্রাকৃতিক আবহে খুঁজে পাবেন জীবনানন্দের মত দু-দন্ড শান্তি আর স্নিগ্ধতার ছোঁয়া।
৩. সোনারগাঁ পানাম নগর: ইতিহাসের অলিগলি
পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলার রাজধানী হিসেবে পরিচিত সোনারগাঁ সুলতানী, মুঘল এবং ঔপনিবেশিক স্থাপত্যে সমৃদ্ধ। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর – প্রাচীন সোনারগাঁর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সোনারগাঁর ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অপূর্ব এই পানাম নগরী গড়ে ওঠে। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে।
পানাম নগরীর সবচেয়ে প্রধান আকর্ষণ এখানকার পুরনো ভবনগুলো । এই বাড়িগুলো বেশিরভাগই এক থেকে তিনতলা বিস্তৃত এবং স্থাপত্যে মোঘল, গ্রিক, এবং ঔপনিবেশিক শৈলীর অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। নির্মাণশৈলীতে জটিল কারুকার্য, কাস্ট আয়রনের কাজ, মোজাইক মেঝে এবং নীল-সাদা নকশা চোখ ধাঁধানো। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে ইনডোর ও আউটডোর উঠান, যা গোপনীয়তা ও ব্যবহারিকতার সমন্বয় সাধন করে।
পানাম নগরীর পরিকল্পনা অত্যন্ত নিখুঁত, যেখানে প্রধান রাস্তা, খাল এবং পুকুর রয়েছে পানির সরবরাহ নিশ্চিত এবং জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখার জন্য । আবাসিক ভবন ছাড়াও, এখানে মসজিদ, মন্দির, প্রাচীন টাঁকশাল ভবন এবং ৪০০ বছরের পুরোনো গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে, যা নগরীর সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক গুরুত্বকে তুলে ধরে।
মাঝে মাঝে যখনই ইচ্ছে করবে যে ইতিহাসের সোনালি পাতা উলটিয়ে দেখি আর হারিয়ে যাই কোনও এক রাজা-বাদশাহর যুগের ঐতিহাসিক এক সমৃদ্ধ রহস্যময় শহরে, তখন আপনি যেতে পারেন সোনারগাঁও এর পানাম নগরে, যেখানে প্রবেশ করলেই মনে হবে যেন সময়ের সাথে এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণ শুরু হয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত আপনাকে নিয়ে যাবে ইতিহাসের এক নতুন জগতে!
৪. গাজীপুর: নির্জনতার অভিজ্ঞান
সবসময় যে কক্সবাজার,সিলেট কিংবা সেইন্ট মার্টিনই যাওয়া সম্ভব হবে এমন তো ন! মাঝে মাঝে উইকেন্ডে ঢাকা শহরের অদূরেই কোন একটা নামিদামি হোটেল বা রিসোর্টে পরিবারের সদস্য বা বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরে আসার জন্য ইদানিং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ডেসটিনেশন হল গাজীপুরে অবস্থিত মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা রিসোর্টগুলো ।
এখানকার সবুজে ঘেরা রিসোর্টগুলো শহরের কোলাহল থেকে দূরে কাটানোর জন্য আদর্শ স্থান। উল্লেখযোগ্য কয়েকটা রিসোর্ট হল সারাহ রিসোর্ট, ছুটি রিসোর্ট, ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা, গ্রিন ভিও গল্ফ রিসোর্ট, নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট ইত্যাদি। এসব রিসোর্টগুলোর কোনটা লাক্সারি রিসোর্ট আবার কোনটা বাজেট ফ্রেন্ডলি,কোনটাতে গ্রামীন আবহ কিংবা নৌ ভ্রমনের ব্যাবস্থা, আবার কোনোটায় আছে বিলাসবহুল লেইকসাইড কিংবা ওয়াটার ফ্রন্ট বা সানসেট ভিলায় পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর পাশাপাশি অন্যান্য অনেক বিনোদনের আয়োজন।
এই যে ধরুন সারাহ রিসোর্ট, এখানে আপনি পাবেন প্রকৃতির সান্নিধ্য আর আধুনিক সব সুযোগ সুবিধার সমাহার। ইকো-ফ্রেন্ডলি বাংলো, জাকুজি, সুইমিং পুল, কিডস পুল, নানা রকম ফান গেইমস অ্যান্ড এক্টিভিটিস এবং খেলার মাঠ সবকিছুই আছে আপনার বিনোদনের জন্য। পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সাথে এখানে ফুটবল, ভলিবল, এবং টেবিল টেনিসও উপভোগ করতে পারেন। স্টেকেশন কিংবা ডে ট্যুর দুটোর জন্যই পারফ্যাক্ট।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের পাশেই অবস্থিত ছুটি রিসোর্ট , যেখানে আপনি নৌকা ভ্রমণ এবং মাছ ধরার আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। তাছাড়া এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে তাঁবুতে রাত্রিযাপনের ব্যাবস্থা আছে, যেটা হতে পারে আপনার জন্য সম্পূর্ণ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।আরও আছে গ্রামীণ পিঠার স্বাদ , খেতে খেতেই হারিয়ে যেতে পারেন ছেলেবেলার স্মৃতিতে । ডে ট্যুরের জন্য এই রিসোর্টটি বেশ উপযোগী ।
ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা হলো একটি বিলাসবহুল স্টেকেশনের স্বপ্নপুরী। এখানে রয়েছে স্পা সুবিধা, যা আপনার ক্লান্তি দূর করে মনের শান্তি এনে দেবে। এই রিসোর্টটিও মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা।
গ্রিন ভিও গল্ফ রিসোর্ট গল্ফ প্রেমীদের জন্য এক দারুণ লোকেশন। এখানে আপনি চমৎকার গল্ফ খেলার পাশাপাশি প্রশান্ত পরিবেশে ইন হাউস রেস্টুরেন্টের সুস্বাদু খাবার উপভোগ করতে পারবেন। এটি স্টেকেশন এবং ডে ট্যুর উভয়ের জন্যই উপযোগী ।
নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্টের প্রধান আকর্ষণ এখানকার নৈসর্গিক পরিবেশ। রাতের আকাশের জ্যোৎস্না দেখতে চাইলে এদিকটায় এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয়না। এখানে আপনি ক্যাম্পফায়ার এবং বারবিকিউ এর মাধ্যমে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। তাছাড়া ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এবং নলজানী বিনোদন পার্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে করবে বিমোহিত। এখানে কাটানো সময় মনে হবে যেন স্বর্গীয় শান্তি আপনার চারপাশে বিরাজ করছে।
৫. নিকলি হাওর: জলরাশির নীরবতা
নিকলী হাওর নামের প্রকৃতির এই মোহনীয় স্বপ্নরাজ্য কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায়, সদর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। শুষ্ক মৌসুমে হাওরটা আবার অন্যরকম লাগে। আর জ্যোৎস্না রাতে এর সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে যায়। যদি তরতাজা মাছের স্বাদ, স্বচ্ছ পানির খেলা, আর ছোট ছোট গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাহলে নিকলী হাওর ঘুরে আসতে পারেন।
বর্ষাকালে বিশাল জলরাশির নীরবতায় হারিয়ে যাওয়া গ্রামগুলো দেখে মনে হয় যেন শান্ত প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গনে সুরক্ষিত এক একটা দ্বীপ। হাওরের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল আর করচ গাছের সারি যেন প্রকৃতির এক মায়াবী চিত্রকল্প। নৌকায় ভেসে চলার সময়, হাওরের নীল জলরাশির স্নিগ্ধতা এবং শিশুদের ভাটিয়ালি গানের মিষ্টি সুর প্রাণকে বিমোহিত করে তোলে।
শীতল বাতাসে উড়ন্ত শুশুকের লাফ-ঝাঁপ আর সবুজের মাঝে হারিয়ে যাওয়া ছাতিরচরের বন যেন স্বপ্নের মতোন- এ যেন আরেকটা রাতারগুল। হাউরের অদুরে যেসব ঘর দেখা যায়, ওখানের মানুষগুলোর জীবনযাত্রা নির্বাহ হয় হাওরকে কেন্দ্র করেই, এরা মূলত মাছ ধরা কিংবা কৃষিকাজে নিযুক্ত, আর তাদের সহজ সরল জীবনযাত্রা মনকে ছুঁয়ে যায়।
বর্ষাকালে বিশাল জলরাশির নীরবতায় হারিয়ে যাওয়া গ্রামগুলো দেখে মনে হয় যেন শান্ত প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গনে সুরক্ষিত এক একটা দ্বীপ। হাওরের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল আর করচ গাছের সারি যেন প্রকৃতির এক মায়াবী চিত্রকল্প। নৌকায় ভেসে চলার সময়, হাওরের নীল জলরাশির স্নিগ্ধতা এবং শিশুদের ভাটিয়ালি গানের মিষ্টি সুর প্রাণকে বিমোহিত করে তোলে।
শীতল বাতাসে উড়ন্ত শুশুকের লাফ-ঝাঁপ আর সবুজের মাঝে হারিয়ে যাওয়া ছাতিরচরের বন যেন স্বপ্নের মতোন- এ যেন আরেকটা রাতারগুল। হাউরের অদুরে যেসব ঘর দেখা যায়, ওখানের মানুষগুলোর জীবনযাত্রা নির্বাহ হয় হাওরকে কেন্দ্র করেই, এরা মূলত মাছ ধরা কিংবা কৃষিকাজে নিযুক্ত, আর তাদের সহজ সরল জীবনযাত্রা মনকে ছুঁয়ে যায়।
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এখানে রয়েছে হাউস বোটে করে নৌকা ভ্রমণের অপূর্ব অভিজ্ঞতা, যেখানে নিকলীর স্বাদে তাজা মাছের রান্না ও উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাত কাটানোর সুযোগ মুগ্ধ করে।
ঢাকার কোলাহল থেকে দূরে, কিশোরগঞ্জের পথে ছুটে চলার এই যাত্রা, নিকলী হাওরের শান্ত সৌন্দর্য আপনার মনকে নতুন রঙে রাঙিয়ে তুলবে, প্রকৃতির এই নীরবতা আর গ্রামের গন্ধ আপনাকে বার বার এখানে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানাবে প্রতিটা মুহূর্ত, যার রেশ রয়ে যাবে বহুদিন!
সন্ন্যাসি রাজার সেই রহস্যে ঘেরা জমিদার বাড়ির খোঁজ চাই? অথবা রাজধানী থেকে কাছেই স্বল্প খরচে সাগরপাড়ে সূর্যাস্ত কোথায় দেখতে পাওয়া যায়? ৭১-এ মুক্তিবাহীনির ট্রেইনিং ক্যাম্প হিসেবে ব্যাবহ্রত কোন সে জমিদার বাড়ি?
পরের পর্বে থাকবে এমন সব মনমুগ্ধকর স্থানের বর্ণনা। সাবস্ক্রাইভ করে নোটিফিকেশন অন করে রাখুন!