ওয়েলকাম ব্যাক! চলে এলাম বহুল কাঙ্ক্ষিত ঢাকার আশেপাশে ১০টি মনোমুগ্ধকর স্থান হিসেবে পারফেক্ট ডেসটিনেশনের সন্ধান নিয়ে। আজকের পর্বে যে জায়গাগুলো নিয়ে লিখছি, সেগুলো যে শুধু ভ্রমন পিপাসুদের ক্ষুধা মিটাবে তাই নয়, বরং যারা ভ্রমনের পাশাপাশি ইতিহাস ও প্রাছিন বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে জানার আগ্রহ রাখেন,তাদের মনেও জাগাবে রোমাঞ্চকর অনুভূতি। চলুন,আর ভুমিকা না করে শুরু করি-
ঢাকার আশেপাশে ১০টি মনোমুগ্ধকর স্থান – বালিয়াটি থেকে মৈনট
৬. বালিয়াটি প্রসাদ: ইতিহাস ও আভিজাত্যের ছোঁয়া
প্রথমেই বলবো মানিকগঞ্জের বালিয়াটী প্রসাদ বা জমিদার বাড়ির কথা, রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্যের এক অনন্য স্মারক এই জায়গাটি। এখানকার স্থাপত্যেগুলোর প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের গল্প। ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে আনুমানিক আট কিলোমিটার পশ্চিমে এবং ঢাকা জেলা সদর থেকে পয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত।
বালিয়াটি প্রাসাদ সাতটি স্থাপনা নিয়ে গঠিত, বর্তমানে প্রাসাদের কেন্দ্রীয় ব্লকটি একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এটি বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সংরক্ষণ ও পরিচালনায় রয়েছে। প্রাসাদের এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলি তার নির্মাণ ইতিহাস এবং বর্তমান ব্যবহারের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। চাইলেই আপনি এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি থেকেও ঘুরে আসতে পারেন কিংবা নৌকায় চড়ে এর আশেপাশের নদীগুলোও ভ্রমণ করতে পারেন।
৭. মহেরা জমিদার বাড়ি: ইতিহাসের সাক্ষী
টাঙ্গাইলের মহেরা জমিদার বাড়ি দেশের অন্যতম সংরক্ষণশীল স্থাপত্য নিদর্শন। প্রাচীন স্থাপত্যের মোহনীয়তা আর ইতিহাসের গভীরতা যদি আপনাকে মুগ্ধ করে, তবে আপনার ঘুরে আসার তালিকায় এটি অবশ্যই থাকতে হবে। টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি আপনার কল্পনাকে ছাপিয়ে যাবে তার স্থাপত্যিক সৌন্দর্য দিয়ে।
প্রায় আট একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত, মহেরা জমিদার বাড়ি নির্মিত হয়েছিল ১৮৯০ সালের আগে, স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই জমিদার বাড়ি ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্প, যা তার ইতিহাসকে আরও গৌরবান্বিত করে। বর্তমানে এটি একটি পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তবুও তার পুরোনো দিনের আভিজাত্যের ছোঁয়া আজও বিরাজমান।
আপনি যখন এই জমিদার বাড়িতে পা রাখবেন, তখনই সামনে পড়বে বিশাখা সাগর নামে বিশাল দীঘি আর সুরম্য গেট। প্রবেশের পরেই চৌধুরী লজের মোহনীয় গোলাপি রঙের ভবনটি আপনাকে স্বাগত জানাবে, যা রোমান স্থাপত্য শৈলীর এক অনন্য উদাহরণ। এরপর রয়েছে মহারাজ লজ, যার বাইজেনটাইন স্থাপত্য শৈলী আর ঝুলন্ত বারান্দা শুটিং স্পট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়।
পরবর্তী গন্তব্য হতে পারে আনন্দ লজ, যার নীল ও সাদা রঙের মিশ্রণ এবং সামনের আটটি সুদৃশ্য কলাম আপনাকে বিমোহিত করবে। এখানের বাগানে হরিণ ও পশু-পাখির ভাস্কর্য যেন এক শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। আর সবশেষে কালীচরণ লজ, যা ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির আদলে নির্মিত। বিকেলের সূর্যের আলো যেন এর প্রতিটি কোণায় আলোর খেলা তৈরি করে।
মহেরা জমিদার বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাসের অংশ, যেখানে প্রতিটি ইট আর পাথর এক একটি গল্প বলে। এই জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য, ইতিহাস আর স্থাপত্য কৌশল আপনাকে বারবার ফিরে আসতে বাধ্য করবে। তাই আর দেরি না করে আপনার পরবর্তী গন্তব্য হোক মহেরা জমিদার বাড়ি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জমিদার বাড়ির আভিজাত্য আপনার ভ্রমণকে করবে আরও রোমাঞ্চকর।
৮. মৈনট ঘাট বা মিনি কক্সবাজার : সূর্যাস্তের গান
ঢাকার দোহারে পদ্মা নদীর পাড়ে অবস্থিত ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে পরিচিত মৈনট ঘাট । একে মিনি কক্সবাজার বলার কারণ হল এখানে ঘুরতে গেলে আপনি সুযোগ পাবেন নদীর তীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার । এখানকার উত্তাল পদ্মার ঢেউ ও জেলেদের নৌকা ভ্রমণ আপনাকে সমুদ্র সৈকতের অনুভূতি দেবে। বর্ষাকালে মৈনট ঘাটের সৌন্দর্য উপভোগের সেরা সময়। ভোরবেলা এখানে এলে জেলেদের ধরা ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের বাজার দেখতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে মাছও কিনতে পারেন। ঘাটের পাশে নবাবগঞ্জের জজবাড়ি, উকিলবাড়ি ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থানও দেখা যায়।
ঢাকা থেকে বাসে মাত্র ৯০ টাকায় দেড় থেকে আড়াই ঘণ্টায় মৈনট ঘাটে পৌঁছানো যায়। শেষ বাসটি সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরে আসে। প্রাইভেট কার বা বাইক নিয়েও আসা যায়। যদিও থাকার জন্য কোনো হোটেল বা রিসোর্ট নেই, তবে দিনের মধ্যে ফিরে আসতে পারেন।
খাবারের জন্য পদ্মার তীরে বসে ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছা পূরণ করতে পারবেন। নৌকায় চড়ে নদীর বুকে ভেসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আপনার ভ্রমণকে করবে আরও স্মৃতিময়। এখানকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই মনে হবে বিশেষ।
৯. ভাওয়ালের রাজবাড়িঃ সন্যাসী রাজা
গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ী এমন একটি ইতিহাস আর স্থাপত্যের নিদর্শন যেখানে মেলবন্ধন ঘটেছে লোকমুখে প্রচলিত রহস্যেরও। এই প্রাসাদে প্রবেশ করলে আপনি যেন এক মোহময় জগতে পা রাখেন, এখানের প্রতিটি ইট আর কারুকাজ যেন একটি করে গল্প বলে। বিশেষ করে, মৃত্যুর ১২ বছর পর পুনর্জীবনের সেই ভাওয়াল সন্ন্যাসীর ঘটনা যা আজও মানুষের মনে অদম্য কৌতূহল জাগায়।
রাজবাড়ীতে প্রবেশের সময় নাগলিঙ্গম ফুলের মিষ্টি গন্ধ আপনাকে স্বাগত জানাবে এক রোমহর্ষক মায়াপুরীতে, এবং বিশাল হলঘর আর সমতল মাঠে হাঁটতে হাঁটতে আপনি অনুভব করবেন এক অন্যরকম রোমাঞ্ছের।
রাজবাড়ীর ৩৬৫টি কক্ষের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে আপনার মানসপটে ভাসবে রাজা-রানিদের সেই জমকালো দিনগুলো, নাচের জলসা কিংবা কবিতার আসর- যখন এই প্রাসাদ ছিল প্রাণবন্ত। বিশাল দীঘি এবং ফুলে ছাওয়া বাগান দিয়ে ঘেরা এর পারিপার্শ্বিক পরিবেশও বেশ সুন্দর।
ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা ও শিবপুর মোড় হয়ে এই রাজবাড়ী পৌঁছানো যায়। যদি ট্রেনে আসতে চান, জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশনে নেমে রিকশায় আসা যায়। সারাদিন ঘুরে ঢাকায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হলেও, আশেপাশের রিসোর্টগুলোতে রাত কাটানোর জন্য ছুটি, সারাহ, বা নক্ষত্র বাড়ি বেছে নিতে পারেন।
১০. সাইবেরিয়ান হাস্কি কেনেল: পশুপ্রেমীদের স্বর্গ
ঢাকার কাছেই অবস্থিত সাইবেরিয়ান হাস্কি কেনেল পশুপ্রেমীদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান। এখানে হাস্কি কুকুরদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন, যা আপনার দিনটিকে করে তুলবে আরও আনন্দময়। এখানে এসে আপনি শুধু যে প্রিয় সাইবেরিয়ান হাস্কিদের সাথে সময় কাটিয়ে মন ভালো করবেন তাই শুধু নয়, মনোরম পরিবেশে প্রকৃতির কোলে শান্তি খুঁজে নেওয়ার সুযোগও পাবেনজন
ঢাকার যেকোনো লোকেশন থেকে সাভারের হেমায়েতপুর বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে সেখান হতে বাকি পথ অটো রিকশায় করে এই কেনেলে পৌঁছে যাবেন। এখানে ভেতরে একটি রেস্তোরাঁও রয়েছে যেখানে বিভিন্ন রকমের খাবারের ব্যবস্থা আছে, তবে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে বাইরে বেরিয়ে মিস্টার খান ফুডপার্কে খেতে পারেন, অথবা ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে আল মাদানি রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার উপভোগ করতে পারেন।
এই জায়গাটি পশুপ্রেমিদের ডে-ট্যুরের জন্য একটা সেরা গন্তব্য হতে পারে, যেখানে আপনি প্রকৃতির আর প্রিয় পোষা প্রাণীদের সাথে সময় কাটিয়ে নিজের মনকে প্রশান্তি দিতে পারবেন। তাই, আপনার ব্যস্ত জীবনে কিছু সময় খুঁজে বের করে এখানে ঘুরে আসুন এবং নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করুন।
পরিশেষে-
ঢাকার আশেপাশের এই মনোমুগ্ধকর গন্তব্যগুলো যেন একেকটি জাদুকরী ক্যানভাস, প্রতিটিই আলাদা গল্প আর অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনার স্মৃতির ঝুলিকে পূর্ণ করতে বসে আছে। ধূসর শহরের একঘেয়েমির চক্র থেকে কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে আসতে এবং জীবনে নতুন রঙ যোগ করতে ইচ্ছুক ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এগুলোই হতে পারে সেরা চয়েসই। রহস্যময় ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রকৃতির নিস্তব্ধ সৌন্দর্য, আর নদীর তীরে বয়ে চলা বাতাসের মিষ্টি ছোঁয়া কিংবা প্রিয় পোষা প্রাণীর নৈকট্য- এ সবকিছুই আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে, পরিবার বা বন্ধুদের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই হয়ে উঠবে এক একটি ছোট্ট অ্যাডভেঞ্চার!
তাই আর অপেক্ষা কেন? ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ুন, ঢাকার অদূরের এই রত্নগুলোর সন্ধান করতে!